ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল |
Causes and consequences of the Crimean War
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ :
অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে রাশিয়া তুরস্ক দখল করার চেষ্টা করলে, বলকান অঞ্চলে গুরুতর সংকট সৃষ্টি হয় যা, বলকান সমস্যা নামে পরিচিত। মূলত এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে ১৮৫৩ সালে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮৫৪ সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির পিডমন্ট-সার্ডেনিয়া সহ কিছু দেশ তুরস্কের পক্ষ অবলম্বন করলে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ :
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ কে দু ভাগে ভাগ করা যায়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ কারণ :
- রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি : অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার কারণে বলকান সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে রাশিয়া ১৮৩০ সালে তুরস্কের কাছ থেকে বসফরাস ও দার্দানেলস প্রণালীতে রুশ জাহাজ চলাচলের অধিকার আদায় করে। রাশিয়ার এই শক্তি বৃদ্ধিতে ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
- তুরস্ক দখলের পরিকল্পনা : ১৮৫৩ সালে রাশিয়া ইংল্যান্ড এর কাছে তুরস্ককে ব্যবচ্ছেদ করে দুই পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার প্রস্তাব পাঠায়। রাশিয়ার এই পরিকল্পনা ইংল্যান্ড ভালো চোখে নেয়নি।
- রাশিয়ার তুরস্ক আক্রমণ : এই পরিস্থিতিতে ১৮৫৩ সালে রাশিয়া দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী দুটি তুর্কি প্রদেশ দখল করে নিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
- ফ্রান্সের যুদ্ধাকাঙ্খা : ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পূর্বের মস্কো অভিযানের ব্যর্থতার প্রতিশোধ নিতে এবং ফ্রান্সের গরিমা বৃদ্ধি করতে চাইছিলেন। এই উদ্দেশ্যে ফ্রান্স তুরস্কের পক্ষ অবলম্বন করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
- ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক স্বার্থ : বলকান অঞ্চলে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক তথা উপনিবেশিক স্বার্থেকে ক্ষুন্ন করবে এই ভাবনায় রাশিয়ার এই আক্রমণরাশিয়ার এই আগ্রাসনকে ইংল্যান্ড ভালো চোখে দেখেনি।
- অস্ট্রিয়ার উদ্দেশ্য : অস্ট্রিয়া মনে করতো যে, বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য বাড়লে তার স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এই হিসাব মাথায় রেখে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সমর্থন জানালে পরিস্থিতি আরো সংকট জনক হয়ে পড়ে।
- ইতালির ঐক্যের বাসনা : ইতালির ঐক্য আন্দোলনে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহযোগিতা পাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে পিডমন্ট ও সার্টেনিয়া ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ :
১৮৩৩ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে আংকিয়ার স্কেলেসির সন্ধি হয়। এই সন্ধির সূত্র ধরে ১৮৫৩ সালে রাশিয়া তুরস্কের অন্তর্গত গ্রীক গির্জা এবং সেখানকার অধিবাসীদের উপর আধিপত্য স্থাপনের দাবি করলে ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালির সার্ডিনিয়া-পিডমন্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, স্পেন ও রোমান ক্যাথলিক শক্তিবর্গ তুরস্কের পক্ষ অবলম্বন করলে ১৮৫৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলকে দুভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। যথা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল :
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ফলাফলগুলো হল :
- বিপুল প্রাণ ও সম্পদহানি : ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এবং কিছুদিনের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়
- রাশিয়ার আগ্রাসন রুদ্ধ : বসফরাস ও দার্দেনেলিস প্রণালী, কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়।
- তুরস্কের অখন্ডতা রক্ষা : তুরস্ক রাশিয়ার কাছে হারানো অঞ্চলগুলো পুনরায় ফিরে পায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তাদের কাছ থেকে তুরস্কের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পায়।
- ফ্রান্সের মর্যাদা পুনরুদ্ধার : তৃতীয় নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে যুক্ত হয়ে রাশিয়াকে পরাজিত করার ফলে ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে।
প্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ( সুদূর প্রসারী ) ফলাফল :
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী ফলাফলগুলো হল :
- জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ : ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় যার তন্ত্রের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসে পড়ে।ফলে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গন আন্দোলন দানা বাঁধে যা হাজার ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পটভূমি তৈরি করে।
- রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার বিলোপ : গণআন্দোলনের চাপে পড়ে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার উদারনৈতিক সংস্কার চালু করেন এবং ভূমিদাস প্রথা বিলোপ করতে বাধ্য হন।
- ইতালি ঐক্য : ইতালীর পিডমন্ট সার্ডেনিয়া এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ায় বিজয়ী জোটের সমর্থনে ইতালির ঐক্য সহজ হয়ে যায়।
- জার্মানির ঐক্য : এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়ায় পরবর্তীকালে অস্ত্রপ্রকাশীয় যুদ্ধের সময় রাশিয়া-অস্ট্রিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্যের পথ প্রস্তুত হয়।
- বলকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভব : ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে এবং জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবিতে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে।
- মধ্য এশিয়ায় রুশ ভীতি : এই যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। ফলে মধ্য এশিয়ায়, বিশেষ করে আফগান সীমান্তে, রুশ ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।
- মেটারনিক তন্ত্রের অবসান : বলকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের প্রভাবে ইউরোপ থেকে মেটারনিক তন্ত্রের প্রভাব পুরোপুরি মুছে যায়।
- ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ : এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ থাকলেওমধ্য এশিয়ায় রুশভীতির কারণেব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য সংকটে পড়ে।
উপসংহার :
ঐতিহাসিক রবার্ট মরিয়া বলেছেন, আধুনিককালের সবচেয়ে অনাবশ্যক ও অযৌক্তিক যুদ্ধ হলো প্রিমিয়ার যুদ্ধ। তবে, উপরোক্ত ফলাফলের নিরিখে এই যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক লর্ড ক্রোমার এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে প্রিমিয়ার যুদ্ধকে ইউরোপের ইতিহাসের জলবিভাজিকা বলে অভিহিত করেছেন।
-------------------xx---------------
বিকল্প প্রশ্ন সমূহ :
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা করো। ইউরোপের ইতিহাসে এই যুদ্ধের গুরুত্ব কি ছিল?
- ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ সংক্ষেপে লেখো। এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল বর্ণনা করো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন